সিলেট বাংলানিউজ২৪.কমঃ ২০১৮ সালে ইমরান খান যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন তার পক্ষেই কাজ করছে।ক্রিকেট খেলার সেই দিনগুলো থেকেই একজন জাতীয় বীর, তারপর একজন ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে রূপান্তর ঘটে তার।
বহু দশক ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে গেঁড়ে বসা প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরিবারকে বেশ সংগ্রামের পর অপসারণ করতে পেরেছিলেন ইমরান খান।
প্রাণবন্ত রাজনৈতিক সমাবেশ, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জোরালো উপস্থিতিসহ তার আবির্ভাব হয়েছিল দুর্নীতিবিরোধী নতুন শক্তি হিসেবে। তিনি পরিবর্তন আর নতুন পাকিস্তান গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানে এপর্যন্ত কোন প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। মনে হচ্ছিল যেন ইমরান খান হয়তো প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই ইতিহাস বদলাতে পারবেন।
যে কারণে তাকে তার অবস্থানে খুব সংহত মনে হয়েছিল সেই একই কারণ দিয়েই তার পতন ব্যাখ্যা করা যায়।
ইমরান খান পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন বলে মনে করা হয় – যদিও দুই পক্ষই এমন দাবি অস্বীকার করে। কিন্তু এখন তাদের সঙ্গে সেই সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
২০১৮ সালে যদিও তার জনসমর্থন ছিল। একই সঙ্গে তার গোপন খুঁটির জোর ছিল সেনাবাহিনী।
সমালোচকরা ইমরান খানের শাসনকালকে ‘হাইব্রিড’ সরকার বলে আখ্যা দিয়ে এসেছে। তার প্রতি সেনা সমর্থনের নানা উদাহরণও রয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় যেসব সংবাদসংস্থা তার প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে তাদের অবস্থান সংকুচিত হতে দেখা গেছে।
সেসময় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কিছু প্রার্থীকে প্ররোচিত করে অথবা চাপ প্রয়োগ করে তার দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।
বিশ্বের দরবারে ইমরান খানের উপস্থিতি ছিল ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে।
অন্যদিকে সেনাবাহিনী-বিশেষ করে সেনাপ্রধান এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের বিরুদ্ধে বিরোধীদের কণ্ঠ জোরালো হতে শুরু করে। রাজনীতির গতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসে গত বছর।
বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিবিসিকে বলেছিলেন যে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে সুশাসন নিশ্চিত করতে ইমরান খানের ব্যর্থতায় সেনাবাহিনীতে বিরক্তি বাড়ছিল এবং সম্ভবত তাকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপারে যে সমালোচনার মুখে তারা সেনাবাহিনী ছিল সেটির প্রভাব পড়ছিল।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া এবং গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়েজ হামিদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়ায়।
ফায়েজ হামিদ পরিবর্তী সেনাপ্রধান হওয়ার আশা পোষণ করতেন।
সেনাপ্রধান হওয়ার ব্যাপারে তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে এমনকি তিনি আফগান কর্মকর্তাদের সাথে সে ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছিলেন।
জেনারেল বাজওয়া এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফায়েজ হামিদের মধ্যেকার বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিল গত গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রভাবশালী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে এক আলাপচারিতার সময়।
একজন সাংবাদিক একটি প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু আইএসআই প্রধান বলে বসেন যে সময় শেষ হয়ে গেছে।
‘আমি হচ্ছি সেনাপ্রধান এবং আমি সিদ্ধান্ত নেব কখন সময় শেষ হবে’, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন জেনারেল বাজওয়া।
এমনকি ওই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরও দেন সেনাপ্রধান। অক্টোবর মাসে তাদের দুজনের বিরোধ চরমে পৌঁছায় এবং এর মধ্যখানে পড়ে যান ইমরান খান।
জেনারেল বাজওয়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে নতুন কারো কথা ভাবছিলেন এবং বিভিন্ন পদে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিল সেনাবাহিনী।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন ইমরান খান, যিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত আইএসআই প্রধান স্বপদে থাকুন সেটা চাইছিলেন ইমরান খান।
তিনি মনে করছিলেন যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ তাকে আরো একবার জয়ী হতে সাহায্য করতে পারবেন।
তার পদ পরিবর্তন বিষয়ক প্রজ্ঞাপন সপ্তাহ খানেক আটকিয়েও রেখেছিলেন ইমরান খান, যদিও শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে হয় তাকে।
তবে এসব কারণে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের সরকারের সম্পর্কের ফাটল আরো প্রকাশ্য হয়।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে যখন অনাস্থা ভোটের পরিকল্পনা হচ্ছিল, তার দল থেকে কারা বেরিয়ে যাবেন সেটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
তখন বেশ কটি সূত্র থেকে বিবিসিকে বলা হয়েছিল, সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে বলে উল্লেখ করেছে।
ইমরান খানের দলত্যাগী একজন বিবিসিকে বলেছেন, তিনি এবং অন্য সংসদ সদস্যরা গোয়েন্দা বাহিনী থেকে ফোন কল পেতেন এবং তাদেরকে বলে দেয়া হতো কি করতে হবে।
পররাষ্ট্র নীতিতেও ইমরান খানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতবিরোধ ছিল।
রাশিয়ান সেনাবাহিনী যেদিন ইউক্রেনের সীমান্ত অতিক্রম করেছিল সেদিন মস্কো সফর করেছিলেন ইমরান খান।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা চেষ্টা করছিলেন ইমরান খান যেন ভ্লাদিমির পুতিনের নিন্দা জানান। কিন্তু তাতেও সাড়া দেননি তিনি।
ওদিকে সেনাবাহিনীর ছিল একেবারে ভিন্ন সুর। জেনারেল বাজওয়া গত সপ্তাহে বলেছেন, রাশিয়ার ‘এই হামলা অবশ্যই অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে’।
ইমরান খান যদিও বারবার বলে গেছেন যে, তিনি লড়াই থেকে সরে দাঁড়াবেন না এবং তিনি ‘যুক্তরাষ্ট্রের শাসক পরিবর্তন চেষ্টার শিকার’।
কারণ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি পশ্চিমাবিরোধী হয়ে উঠছে এবং আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধের সমালোচনা করেছে।
যদিও তার এই দাবি অতিরঞ্জিত বলে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। তবে ইমরান খানের সমর্থকরা মার্কিনবিরোধী মানসিকতায় ক্রমাগত ঢোলের বাড়ি দিয়ে চলেছে।
কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও দেশটিতে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে ‘বিদেশি চক্রান্ত’ ধারণাটি বারবার ব্যবহার করা হয়েছে।
খেলোয়াড়ি জীবনে ইমরান খান তার দলের খেলোয়াড়দের একবার বলেছিলেন ‘কোণঠাসা হয়ে পড়া বাঘের মত লড়াই করতে’।
মনে হচ্ছে তিনি এখন এক ‘কোনাঠাসা বাঘের মত’ শক্তিশালী বিরোধী চরিত্রে পরিণত হতে যাচ্ছেন।
Leave a Reply